bayyinaat

Published time: 19 ,May ,2017      18:18:19
প্রবন্ধ
কোরআনে এমন কিছু আয়াত রয়েছে যাতে ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে আরবদের এক প্রকার তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে এবং তাদের অমনোযোগের দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। ঐ আয়াতগুলোর ভাবার্থ এরূপ যে, ইসলামের তোমাদের প্রতি কোন প্রয়োজন নেই, তাই যদি তোমরা ইসলাম গ্রহণ না কর তবে পৃথিবীতে এমন অনেক জাতি রয়েছে যারা মন হতে ইসলামকে গ্রহণ করবে, এমনকি এরূপ আয়াতসমূহ হতে এও বোঝা যায়, কোরআন ঐ জাতিসমূহের হৃদয়কে ইসলামের জন্য অধিকতর উপযোগী ও প্রস্তুত বলে মনে করে। এ আয়াতগুলো যাথার্থভাবে ইসলামের বিশ্বজনীনতাকে তুলে ধরে।
সংবাদ: 79

ইসলামের আহ্বান কি বিশ্বজনীন?

কোন কোন ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞের দাবি ইসলামের নবী (সা.) প্রথম দিকে চেয়েছিলেন শুধু কুরাইশদের হেদায়েত করতে, কিন্তু পরবর্তীতে ইসলামের প্রসারের গতি লক্ষ্য করে আরব ও অনারব সকলের নিকট এ ধর্মের দাওয়াত উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন।

আমাদের দৃষ্টিতে এ মন্তব্য কাপুরুষতামূলক অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়। আর এ কথার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তিও নেই এবং কোরআনের প্রথম দিকের আয়াত যা নবীর ওপর অবতীর্ণ হয় তাও এ কথাকে অসত্য প্রমাণ করে। কোরআন মজীদে এমন অনেক আয়াত রয়েছে যা রাসূল (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রথম দিকে মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে, অথচ সর্বব্যাপী ও বিশ্বজনীন। তন্মধ্যে কোরআনের ক্ষুদ্র সূরাগুলোর অন্যতম সূরা আত-তাকভীরের কথা উল্লেখ করতে পারি। এ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ ও নবুওয়াতের প্রারম্ভিক একটি সূরা, যার একটি আয়াতে বলা হয়েছে:

﴿إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ

‘এটি বিশ্ববাসীদের জন্য উপদেশ বৈ কিছু নয়।’ (সূরা তাকভীর: ২৭)

সূরা সাবার ২৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে:

﴿وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

‘আমি আপনাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’

সূরা আম্বিয়ার ১০৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন,

﴿وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِنْ بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ

আমরা উপদেশের পর যাবুরে লিখে দিয়েছি, আমার সৎকর্মশীল বান্দাগণ অবশেষে পৃথিবীর অধিকারী হবে।’

সূরা আ’রাফের ১৫৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে:

﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا

হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহ্ প্রেরিত রাসূল।’

কোরআনের কোন স্থানেই «يا أيّها العرب» ‘হে আরব জাতি’ বা «يا أيّها القريشيّون» ‘হে কুরাইশ সম্প্রদায়’ বলে উল্লিখিত হয়নি। কোরআনে কখনও কখনও «يا أيّها الذين آمنوا» এসেছে সে সকল মুমিনের প্রতি লক্ষ্য করে যাঁরা নবীর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন বা হবেন। এ ক্ষেত্রেও মুমিন ব্যক্তি যে কোন জাতি, গোত্র বা বর্ণের হতে পারেন, বিশেষ কোন জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যান্য স্থানগুলোতে সাধারণভাবে «يا أيّها النّاس» ‘হে মানবমণ্ডলী’ বলা হয়েছে।

ইসলামী শিক্ষার সর্বজনীনতা এবং এ দীনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা আরেক ভাবেও প্রমাণ করা যায়। তা হলো কোরআনে এমন কিছু আয়াত রয়েছে যাতে ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে আরবদের এক প্রকার তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে এবং তাদের অমনোযোগের দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। ঐ আয়াতগুলোর ভাবার্থ এরূপ যে, ইসলামের তোমাদের প্রতি কোন প্রয়োজন নেই, তাই যদি তোমরা ইসলাম গ্রহণ না কর তবে পৃথিবীতে এমন অনেক জাতি রয়েছে যারা মন হতে ইসলামকে গ্রহণ করবে, এমনকি এরূপ আয়াতসমূহ হতে এও বোঝা যায়, কোরআন ঐ জাতিসমূহের হৃদয়কে ইসলামের জন্য অধিকতর উপযোগী ও প্রস্তুত বলে মনে করে। এ আয়াতগুলো যাথার্থভাবে ইসলামের বিশ্বজনীনতাকে তুলে ধরে। যেমন সূরা আনআমের ৮৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে:

﴿فَإِنْ يَكْفُرْ بِهَا هَؤُلَاءِ فَقَدْ وَكَّلْنَا بِهَا قَوْمًا لَيْسُوا بِهَا بِكَافِرِينَ

যদি তারা (আরবরা) কোরআনকে অস্বীকার করে তবে অবশ্যই আমরা অন্য জাতিকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করব যারা একে অস্বীকার করবে না অর্থাৎ এর প্রতি ঈমান আনবে ও এর মর্যাদা রক্ষা করবে।’

সূরা নিসার ১৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে:

﴿إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ أَيُّهَا النَّاسُ وَيَأْتِ بِآخَرِينَ وَكَانَ اللَّهُ عَلَى ذَلِكَ قَدِيرًا

হে মানবকুল! মহান আল্লাহ্ চাইলে তোমাদের সরিয়ে অন্য কাউকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। বস্তুত আল্লাহর সে ক্ষমতা রয়েছে।’

আবার সূরা মুহাম্মদের ৩৮ নং আয়াতে এসেছে:

﴿وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوا أَمْثَالَكُمْ

যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও (কোরআন হতে) তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এরপর তারা তোমাদের মত হবে না।’

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বাকির (আ.) বলেন, ‘অন্য জাতি বলতে মাওয়ালীদের (ইরানীদের) কথা বলা হয়েছে।’

অনুরূপ ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন, কোরআন থেকে আরবদের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে এ আয়াত সত্য প্রমাণিত হয়েছে এবং আল্লাহ্ তদস্থলে মাওয়ালী অর্থাৎ ইরানীদের প্রতিস্থাপিত করেছেন যারা মন-প্রাণ দিয়ে ইসলামকে গ্রহণ করেছে।

অবশ্য এখানে আমাদের লক্ষ্য এটি নয় যে, প্রমাণ করব অন্য জতিটি ইরানীই ছিল বা অন্য কেউ; বরং এখানে আমরা যেটি বলতে চাই তা হলো ইসলাম গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে আরব-অনারব ইসলামের দৃষ্টিতে সমান। এ জন্যই আরবরা ইসলামের প্রতি অমনোযোগিতার কারণে পুনঃপুন তিরস্কৃত হয়েছে। ইসলাম আরবদের বুঝাতে চায় তারা ঈমান আনুক বা না আনুক এ দীন অগ্রগতি লাভ করবেই। কারণ ইসলাম এমন দীন নয় যা বিশেষ কোন জাতির জন্য আবির্ভূত হয়েছে।

এখানে অন্য আরেকটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি, তা হলো: কোন ধর্মমত, পথ ও চিন্তা-বিশ্বাস দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে যাওয়া শুধু ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়; বরং সকল বৃহৎ ধর্ম ও মতের ক্ষেত্রে এটি সত্য। বৃহৎ অনেক ধর্ম ও মতবাদই তার উৎসভূমিতে হয়তো অভিনন্দিত হয়নি, কিন্তু তার উৎসস্থলের বাইরের দেশ ও জাতির নিকট গৃহীত ও অভিনন্দিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ হযরত ঈসা (আ.) ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেছেন, কিন্তু ফিলিস্তিনসহ প্রাচ্য হতে পাশ্চাত্যে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা অধিক। ইউরোপ ও আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী, অথচ তারা ভূখণ্ড ও মহাদেশ হিসেবেও হযরত ঈসার জন্মভূমি হতে বিচ্ছিন্ন। এর বিপরীতে ফিলিস্তিনের অধিকাংশ অধিবাসী মুসলমান এবং ইহুদী। খ্রিষ্টানরা থাকলেও খুবই কম। প্রশ্ন হলো আমেরিকা, ইউরোপের অধিবাসীরা কি খ্রিষ্ট ধর্মকে বিজাতীয় মনে করে? আমি জানি না, যে ইউরোপীয়রা অনৈক্যের স্রষ্টা তারা এই জাতীয়তাবাদের উদ্গাতা হিসেবে নিজেদের বিষয়ে কেন এরূপ চিন্তা করে না, অথচ তাদের প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে এ মতবাদ প্রচার করে।

যদি ইসলাম ইরানীদের জন্য বিজাতীয় হয় তবে খ্রিষ্টধর্ম ইউরোপ-আমেরিকার জন্য বিজাতীয় পরিগণিত হবে না কেন?

কারণটি পরিষ্কার। তারা জানে ও অনুভব করেছে প্রাচ্যের দেশগুলোতে শুধু ইসলাম জীবনের এক স্বাধীন দর্শনে বিশ্বাসী যা এর অনুসারীদের স্বাধীনচেতা হিসেবে গড়ে তোলে। যদি এ ইসলাম না থাকে তবে অন্য কোন কিছুই কাল (আমেরিকা) ও লাল  সোভিয়েট ইউনিয়ন) সাম্রাজ্যবাদের চিন্তাকে প্রতিরোধে সক্ষম নয়।

গৌতম বুদ্ধ ভারতে জন্মগ্রহণ করলেও ভারতের বাইরে চীনের শত কোটি লোক এ ধর্ম গ্রহণ করেছে।

যারথুষ্ট্র ধর্ম যদিও ইরানের বাইরে তেমন প্রসার লাভ করেনি, তদুপরি এর জন্ম স্থল আজারবাইজানে বিস্তৃতি না ঘটে আফগানিস্তানের বালখে বিস্তার লাভ করে।

তদ্রূপ মক্কাও রাসূলুল্লাহ্‌র জন্মস্থল হওয়া সত্ত্বেও প্রথমে এর অধিবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করে নি; বরং শত ক্রোশ দূরের মদীনার অধিবাসীরা ইসলামকে আলিঙ্গন করেছিল। ধর্মের কথা বাদ দিলেও বিভিন্ন মতাদর্শ ও রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে পর্যালোচনা করলেও তাই দেখা যায়। বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম প্রসিদ্ধ ও শক্তিশালী মতবাদ হলো কমিউনিজম। কমিউনিজম কার মাথা হতে, কোথায় উৎপত্তি লাভ করেছে আর কোন্ জাতি তা গ্রহণ করেছে। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এ দু’জার্মান বংশোদ্ভূত বর্তমান কমিউনিজমের স্রষ্টা। কার্ল মার্কস তাঁর শেষ জীবনে ইংল্যান্ডে অতিবাহিত করেন। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল বৃটেনের অধিবাসীরা অন্যদের হতে পূর্বে কমিউনিজম গ্রহণ করবে। কিন্তু জার্মান বা ইংরেজরা তাঁর মতবাদ গ্রহণ করেনি; বরং রাশিয়ার জনগণ তা গ্রহণ করে। কার্ল মার্কস ভাবতে পারেননি, তাঁর মতবাদ জার্মান বা ইংরেজরা গ্রহণ করবে না; বরং চীন ও সোভিয়েতরা গ্রহণ করবে।

এই কট্টর জাতীয়তাবাদীদের প্রশ্ন করতে চাই কেন সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনের জনগণ দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে কমিউনিস্ট চিন্তাধারা তাদের দেশের বাইরে থেকে এসেছে তাকে বিজাতীয় বলে প্রত্যাখ্যান করছে না? যদি তাদের এ প্রশ্ন করেন তাহলে হেসে বলবে:

আমি মানব সন্তান, আমায় শয়তান ভেব না

আমার জন্য কখনও তুমি ‘লা হাওলা’ পড় না।’

কোন কোন মতবাদ ও মতাদর্শ তার উৎপত্তি স্থলের বহির্সীমায় অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা লাভ করার বিষয়টি নতুন নয়। ইসলাম তার আবির্ভাবের প্রথমেই এ বিষয়টিকে তার দৃষ্টিতে রেখেছিল।

আরব জাতির অনেকেই কোরআন হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেও ইসলাম অন্যান্য জাতির মধ্যে ব্যাপক প্রসার লাভ করবে এ বিষয়টি ইসলাম পূর্বেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল।

 

তথ্যসূত্র



. তাফসীরুল মিযান ও বাইযাভীর মতে এ আয়াত যখন অবতীর্ণ হয় তখন রাসূল (সা.) সালমান ফারসীর কাঁধে হাত দিয়ে বলেন, তারা এ ব্যক্তির সম্প্রদায় ও জাতি।

. মাজমাউল বায়ান, ৯১ খণ্ড, ১৬৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। সূরা জুমুআর ৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে: আবু হুরায়রা বলেছেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় সূরা জুমআ অবতীর্ণ হয়। তিনি আমাদের তা পাঠ করে শুনান। তিনি  و أخرين منهم لمّا يلحقوا بهم পাঠ করলে আমরা প্রশ্ন করলাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এরা কারা? তিনি সালমান ফারসীর কাঁধে হাত রাখলেন এবং বললেন: যদি ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্রের সমান উচ্চতায়ও থাকে তবে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা আসমান থেকেও ঈমানকে নিয়ে আসবে।’ মা’রেফুল কোরআন, ১৩৬৯ পৃষ্ঠা, ১ম খণ্ড।

. প্রথম হিজরী শতাব্দী ব্যতীত কখনই হেজায (বর্তমান সৌদি আরব) ইসলামের সর্ববৃহৎ কেন্দ্র ছিল না; বরং সব সময় ইসলামের বৃহৎ কেন্দ্রসমূহ মিশর, বাগদাদ, নিশাবুর বা দজলা, ফোরাতের তীরবর্তী অন্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং অনারবরা সেখানে ইসলামের অগ্রগামী পতাকাধারী ছিল।

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: