bayyinaat

Published time: 03 ,December ,2018      09:53:14
কোরআনের আলোকে মহান আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়া (২)
কোরআনের আলোকে মহান আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়া (২) এ. কে. এম. আনোয়ারুল কবীর সারাংশ: বিশ্বজগতের যে বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে এবং এ পর্যায়গুলোর মধ্যে যে বৈচিত্র্য ও পার্থক্য রয়েছে তার সবগুলো একটি পর্যায়ে গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সকল ঘটনা ও কারণ তার থেকে উদ্ভূত ও সৃষ্ট হয়। কার্য ও কারণসমূহের ধারা ও পর্যায় ঐ কেন্দ্র থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় আর এ কেন্দ্রই পবিত্র কোরআনে ‘আরশ’ বলে অভিহিত হয়েছে।
সংবাদ: 146

কোরআনের আলোকে মহান আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়া (২)

এ. কে. এম. আনোয়ারুল কবীর  إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلسَّمَاوَاتِ وَٱلأَرْضَ فِى سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ ٱسْتَوَىٰ عَلَى ٱلْعَرْشِ يُدَبِّرُ ٱلأَمْرَ مَا مِن شَفِيعٍ إِلاَّ مِن بَعْدِ إِذْنِهِ ذٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمْ فَٱعْبُدُوهُ أَفَلاَ تَذَكَّرُونَ ‘নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক হলেন আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। তিনি (বিশ্বজগতের) কর্ম পরিচালনা করছেন। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোন শাফায়াতই (সুপারিশ) নেই। তিনি হলেন তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। সুতরাং তোমরা তাঁরই ইবাদত কর। তোমরা কি শিক্ষা গ্রহণ করবে না।’ (সূরা ইউনূস : ৩)

সারাংশ: বিশ্বজগতের যে বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে এবং এ পর্যায়গুলোর মধ্যে যে বৈচিত্র্য ও পার্থক্য রয়েছে তার সবগুলো একটি পর্যায়ে গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সকল ঘটনা ও কারণ তার থেকে উদ্ভূত ও সৃষ্ট হয়। কার্য ও কারণসমূহের ধারা ও পর্যায় ঐ কেন্দ্র থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় আর এ কেন্দ্রই পবিত্র কোরআনে ‘আরশ’ বলে অভিহিত হয়েছে।

ট্যাগ: কোরআন, মহান আল্লাহর আরশ, সমাসীন হওয়া, বিশ্ব পরিচালনা, ثُمَّ ٱسْتَوَىٰ عَلَى ٱلْعَرْشِ يُدَبِّرُ ٱلأَمْرَ

প্রবন্ধ২: তৃতীয় যে বিষয়টি এখানে আমরা পর্যালোচনা করব তা হলোثُمَ‏ اسْتَوى‏ عَلَى الْعَرْش‏ আয়াতাংশটির পূর্ব ও পরে যে বাক্যগুলো এসেছে। এ আয়াতাংশটি সাতটি সূরায় এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ বাক্যাংশের পূর্বে অথবা পরে মহান আল্লাহ কর্তৃক বিশ্বজগৎ পরিচালনা ও সৃষ্টির ব্যবস্থাপনার বিষয় বর্ণিত হয়েছে। এখানে আমরা চারটি আয়াতের উল্লেখ করছি :

إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلسَمَاوَاتِ وَٱلأَرْضَ فِى سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ ٱسْتَوَىٰ عَلَى ٱلْعَرْشِ يُغْشِى ٱلْلَّيْلَ ٱلنَّهَارَ يَطْلُبُهُ حَثِيثاً وَٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ وَٱلنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ أَلاَ لَهُ ٱلْخَلْقُ وَٱلأَمْرُ تَبَارَكَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلْعَالَمِينَ

তোমাদের প্রতিপালক হলেন সেই আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে সমাসীন হলেন। তিনি দিনকে রাত দিয়ে আবৃত করেন এবং রাত দিনের পেছনে ধাবমান। চন্দ্র ও তারকা রাশি তাঁর নির্দেশের অনুগত। জেনে রাখ, সৃষ্টি ও পরিচালনা তাঁরই (অধীনে) বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ মহা কল্যাণময়।’ (সূরা আরাফ : ৫৪)

إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلسَّمَاوَاتِ وَٱلأَرْضَ فِى سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ ٱسْتَوَىٰ عَلَى ٱلْعَرْشِ يُدَبِّرُ ٱلأَمْرَ مَا مِن شَفِيعٍ إِلاَّ مِن بَعْدِ إِذْنِهِ ذٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمْ فَٱعْبُدُوهُ أَفَلاَ تَذَكَّرُونَ

নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক হলেন আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। তিনি (বিশ্বজগতের) কর্ম পরিচালনা করছেন। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোন শাফায়াতই (সুপারিশ) নেই। তিনি হলেন তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। সুতরাং তোমরা তাঁরই ইবাদত কর। তোমরা কি শিক্ষা গ্রহণ করবে না।’ (সূরা ইউনূস : ৩)

الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ اَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَيٰ عَلَي الْعَرْشِ ۚ الرَّحْمَـٰنُ فَاسْاَلْ بِهِ خَبِيرًا 

সেই সত্তা যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দু’য়ের মাঝে যা আছে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের ওপর অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি পরম করুণাময়, নিবিষ্ট চিত্তে তাঁর কাছে প্রশ্ন কর এ জন্য যে, তিনি সর্বজ্ঞাতা।’

هُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضَ فِي سِتَّةِ اَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ ۚ يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْاَرْضِ وَمَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمَا يَنزِلُ مِنَ السَّمَاءِ وَمَا يَعْرُجُ فِيهَا ۖ وَهُوَ مَعَكُمْ اَيْنَ مَا كُنتُمْ ۚ وَاللَّـهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ 

তিনিই সেই সত্তা যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশের ওপর অধিষ্ঠিত হলেন। যা কিছু পৃথিবরি মধ্যে প্রবেশ করে এবং যা কিছু তার থেকে বের হয় এবং যা কিছু আকাশ থেকে বর্ষিত (অবতীর্ণ) হয় ও যা কিছু ঊর্ধ্বে গমন করে তা তিনি অবহিত। তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন। তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।’ (সূরা হাদীদ : ৪)

এ পর্যায়ে আমরা প্রবন্ধের শুরুতে যে চারটি বিষয়ের উল্লেখ করেছি তার চতুর্থটির প্রতি ইশারা করব। আর তা হলো ইঙ্গিতমূলক বাক্যে শাব্দিক অর্থ মূল লক্ষ্য নয়। বরং শব্দের অন্তরালে যে আবশ্যক অর্থ রয়েছে তা-ই লক্ষ্য। সাহিত্যিক ও ব্যাকরণবিদদের মতে ইঙ্গিতসূচক বাক্যে যে ইঙ্গিতবাহী শব্দমালাকে ব্যবহার করা হয় তা কারণের স্থলাভিষিক্ত, কিন্তু তার মাধ্যমে ফলাফলের অর্থই উদ্দেশ্য থাকে। যেমন আরবি ভাষায় যখন বলা হয় يداه مغلولة বা তার হাত বাঁধা, এর অর্থ হলো সে কৃপণ বা দানশীল নয়। কিংবা যদি বলা হয় کان بابُه مفتوحة বা তার দ্বার ছিল উন্মুক্ত’, এর অর্থ হলো সে অতিথিপরায়ণ। পাঠক লক্ষ্য করেছেন, এখানে প্রত্যক্ষ অর্থ, যেমন ‘হাত বাঁধা থাকা’ বা ‘দ্বার উন্মুক্ত থাকা’ বোঝানো মূল উদ্দেশ্য নয়। কারণ, বাস্তব দৃষ্টিতে তার হাত আদৌ বাঁধা নয় এবং অতিথিপরায়ণ ব্যক্তির দরজাও সবসময় খোলা থাকে- এমন নয়। বরং এর পরোক্ষ ও আবশ্যক অর্থই ইঙ্গিতসূচক বাক্যে উল্লিখিত হয়েছে। যেমনটি আমরা সূরা মায়িদার ৬৪নং আয়াতে আমরা লক্ষ্য করি যেখানে আল্লাহ সম্পর্কে ইহুদিদের এ কথা যে, আল্লাহর হাত বাঁধা يَدُ ٱللَّهِ مَغْلُولَةٌ উত্তরে আল্লাহ বলেছেন  بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ বরং তাঁর দুই হাতই উন্মুক্ত। ইহুদিরা হাত বাঁধা বলতে আল্লাহর ক্ষমতা সীমিত বুঝাতে চেয়েছে। আর আল্লাহও তাঁর হাত উন্মুক্ত বলে তাঁর ক্ষমতার অসীমতা বুঝিয়েছেন।

অতএব, আমরা নিম্নোক্ত চারটি বিষয় এখানে ব্যাখ্যা করলাম :

প্রথমত ‘استوی’ শব্দটি ‘جلوس’ বা বসা অর্থের প্রতিশব্দ নয়; বরং এর প্রকৃত অর্থ স্থিতি লাভ, আধিপত্য স্থাপন ও ক্ষমতা গ্রহণ।

দ্বিতীয়ত ‘عرش’ শব্দটিও আরবিতে ‘سرير’ (আসন) বা ‘أَرائِكِ’ আরাম কেদারা বা পালঙ্ক শব্দের প্রতিশব্দ নয়; বরং বিশেষ ধরনের আসন যাতে স¤্রাট বা রাজা বা প্রধানমন্ত্রী বসেন এবং সেখানে বসে রাজ্যের কর্মকা- পরিচালনা করেন। তাই শাব্দিক অর্থে ‘عرش’ সিংহাসন বা মসনদ বলা যেতে পারে। তদুপরি পবিত্র কোরআনে একটি আয়াতে (গ্ধ ্রذی العرش কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী) ‘আরশ’ শব্দটি আল্লাহর ক্ষেত্রে রূপক অর্থে এসেছে।

তৃতীয়ত পবিত্র কোরআনে (আরবি বাক্য রয়েছে) আয়াতাংশের পূর্বে ও পরে সাধারণত বিশ্ব ও সৃষ্টিজগৎ পরিচালনার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে, যেমন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি, দিবা রাত্র সৃষ্টি, চন্দ্র ও তারকারাশি ইত্যাদির আবর্তন।

চতুর্থত, کنايه বা ইঙ্গিতসূচক বাক্যে প্রত্যক্ষ অর্থ মূল উদ্দেশ্য নয়; বরং পরোক্ষ ও নিহিত অর্থ যা আবশ্যক পরিণতি নির্দেশ করে, তা-ই উদ্দেশ্য।

উপরিউক্ত চারটি বিষয় থেকে আমরা যে সিদ্ধান্তে পৌছি তা হলো :

ثُمَّ ٱسْتَوَىٰ عَلَى ٱلْعَرْشِঅতঃপর তিনি আরশের ওপর সমাসীন হলেন’ বাক্যটিতে মহান আল্লাহ যে বিশ্বজগতের পরিচালনা কর্মে নিয়োজিত আছেন তার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘আরশ’ এখানে শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক, যেহেতু এরূপ আসনে বসেই প্রতিপত্তির সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়। তাই তিনি আরশে অধিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ- যা সৃষ্টি ও বিশ্বজগতকে পরিচালনার কারণ বলে বিবেচিত। যেহেতু পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা না হলে পরিচালনা কর্ম সম্ভব হয় না। তিনি কখনোই বিশ্বজগত সৃষ্টির পর একে পরিচালনার দায়িত্ব স্বাধীনভাবে কারো ওপর ছেড়ে দেননি। মহান আল্লাহ যে পবিত্র কোরআনে ফেরেশতাদের فَالْمُدَبِّرَاتِ اَمْرًا বা ‘বিষয়সমূহের পরিচালক’ বলে পরিচিত করিয়েছেন তাঁরা কখনই তাঁর থেকে স্বাধীন নন; বরং তাঁর অনুমতিক্রমে সকল বিষয় পরিচালনা করেন। কখনই তা মূর্তিপূজক বা মুশরিকদের (مشرک) ধারণার মতো নয় যারা মনে করে যে, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কাউকে স্বাধীনভাবে বিশ্বজগৎ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন অথবা তাদের মধ্যে কাজ বণ্টন করে দিয়ে নিজে (নাউজুবিল্লাহ) বিশ্রাম গ্রহণ করছেন। এরূপ বিষয় সম্পূর্ণ অসম্ভব যে, কোন সৃষ্টি আল্লাহর থেকে স্বাধীন হয়ে কোন দায়িত্ব পালন করতে পারে। কারণ, সকল সৃষ্টি সত্তাগতভাবে আল্লাহর মুখাপেক্ষী এবং এক মহূর্তের জন্যও তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

আমাদের এ দিকটি চিন্তা করে দেখতে হবে যে, কেন আল্লাহ (جلس علی السرير) ‘তিনি আসনের ওপর বসলেন’ অথবা (اتّکی علی الاريکة) ‘পালঙ্কের ওপর হেলান দিলেন’- এ ধরনের বাক্যাবলি ব্যবহার করেননি। যদি আসন গ্রহণই উদ্দেশ্য হতো, তবে ঐ রূপ বলাই উপযুক্ত হতো। কিন্তু যখন আমরা দেখছি তিনি ‘استوی’ এবং ‘عرش’ শব্দ দু’টি ব্যবহার করছেন। তারপর বিশ্বজগৎ সৃষ্টির ও পরিচালনার বিষয় উপস্থাপন করছেন, তা থেকে বোঝা যায় এর উদ্দেশ্য শাব্দিক ও বাহ্যিক অর্থ নয়। কখনই এর উদ্দেশ্য এটা নয় যে, মহান আল্লাহর জন্য সৃষ্টি জগতের মধ্যে বা বাইরে দৃশ্যমান ও বিশাল কিন্তু নির্দিষ্ট আকারের আসন রয়েছে যার ওপর বসে তিনি জগতসমূহকে পরিচালনা করেন। বরং বাক্যটি বিশ্বজগৎ পরিচালনার দায়িত্ব পালনের প্রতি ইঙ্গিত করছে। কিরূপে সম্ভব যে وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ مُّحِيطاً)  মহান আল্লাহ সকল কিছুকে বেষ্টন করে আছেন (এবংاَلَا اِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ مُّحِيطٌ)  জেনে রাখ তিনি সকল কিছুকে বেষ্টন করে আছেন);যিনি সকল স্থানে বিরাজমান (وَهُوَ مَعَكُمْ اَيْنَ مَا كُنتُمْ তোমরা যেখানেই থাকনা কেন তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন)  এবং তিন ব্যক্তির মধ্যে এমন কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে চতুর্থ জন হিসেবে তিনি উপস্থিত থাকেন না এবং পাঁচ ব্যক্তির মধ্যেও  (গোপন পরামর্শ) হয় না যাতে ষষ্ঠ জন হিসেবে তিনি উপস্থিত থাকেন না। তারা (সংখ্যায়) এর চেয়ে কম হোক বা বেশী হোক তিনি তো তাদের সঙ্গেই আছেন তারা যেখানেই থাকুক না কেন। (সূরা মুজাদিলা:৭)

আল্লাহ মহা আরশের অধিপতি’ অর্থ কি?

اللَّـهُ لَا اِلَـٰهَ اِلَّا هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ-এ আয়াতটিতে মহান আল্লাহকে মহাআরশের প্রভু বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা পূর্বে যা আলোচনা করেছি তা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, মহান আল্লাহর আরশ কোন বস্তুগত উপকরণে প্রস্তুত সিংহাসন নয়; বরং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির সাথে বিশ্বজগতকে পরিচালনা করা। অন্যভাবে বলা যায়, বিশ্বজগতে অগণিত ও অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা ঘটছে যেগুলোর প্রত্যেকটির নিকটবর্তী ও সংযুক্ত কারণ রয়েছে। এ সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণ পরস্পর সুশৃঙ্খলভাবে সংযুক্ত এবং তা সম্মিলিতভাবে সঠিক ও চূড়ান্ত এক কারণে গিয়ে পরিসমাপ্ত হয়। আর এই চূড়ান্ত কারণ হলেন মহান আল্লাহ যিনি এ সকল কারণকে বেষ্টন করে আছেন এবং প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে তাঁর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর। সুতরাং বিশ্বজগতের যে বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে এবং এ পর্যায়গুলোর মধ্যে যে বৈচিত্র্য ও পার্থক্য রয়েছে তার সবগুলো একটি পর্যায়ে গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সকল ঘটনা ও কারণ তার থেকে উদ্ভূত ও সৃষ্ট হয়। কার্য ও কারণসমূহের ধারা ও পর্যায় ঐ কেন্দ্র থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় আর এ কেন্দ্রই পবিত্র কোরআনে ‘আরশ’ বলে অভিহিত হয়েছে। এ কারণে যে, সৃষ্টি জগতের সকল বিষয়ের উৎস ও ভাণ্ডার সেখানেই রয়েছে এবং নির্দেশ সেখান থেকে জারি হয়। সমগ্র আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী যেহেতু এ কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই একে ‘মহা আরশ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

সুতরাং বিশ্বজগতের বস্তুগত ও অবস্তুগত (দৃশ্যজগত ও অদৃশ্যজগত) কারণসমূহের ধারা একটি কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয়। এ কেন্দ্রটি সৃষ্টি জগতের সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা প্রতিফলিত হয়। আর আরশের চারিদিকের যে ফেরেশতাদের কথা কোরআন বলেছে, তাঁরা হলেন সেই দল যাঁরা সৃষ্টি জগতে বিভিন্ন কার্যের দায়িত্ব পালন করেন অর্থাৎ ঐ কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশ জারি হয়, তাঁরা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে তা কার্যকর করেন।

এ ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিম্নোক্ত আয়াতের অর্থও আমাদের সামনে স্পষ্ট হয় :

الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَّحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ

"যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চারপাশ ঘিরে আছে তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সাথে এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। আর মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে : ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। অতএব, যারা তওবা করে ও আপনার পথ অবলম্বন করে আপনি তাদের ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।” (সূরা মুমিন : ৭)

মহান আল্লাহ কোন কিছুর সদৃশ নন’- আয়াতটির আলোকে আরশে সমাসীন হওয়া

পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহকে এমন এক সত্তা বলে পরিচয় করিয়েছে যিনি কোন কিছুর সদৃশ নন। আল্লাহ বলেছেন : ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়।’

প্রকৃতপক্ষে এ বাক্যটি মহান আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে মৌলিকতম (ভিত্তিগত) জ্ঞান। যদি এ আয়াতটিকে সঠিকভাবে অনুধাবন করা না হয়, তবে তাঁর কোন গুণকেই চেনা সম্ভব নয়। কারণ, আল্লাহর পরিচিতির পথে সবচেয়ে বিপজ্জনক যে গর্তটি রয়েছে তা হলো তাঁকে তাঁর সৃষ্টির অনুরূপ মনে করা। কারণ, এটি তাকে র্শিকের ভয়ঙ্কর গহ্বরে ফেলে দেয়। মহান আল্লাহ এমন এক সত্তা যিনি সকল দৃষ্টিতে অসীম। আর তিনি ব্যতীত যা কিছু রয়েছে তা সসীম। এ কারণেই কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়। তিনি জীবন, আয়ু, শক্তি ও ক্ষমতা, জ্ঞান, ইচ্ছা শক্তিসহ সকল বৈশিষ্ট্যে অসীমত্বের অধিকারী। এটি অন্য সকল অস্তিত্বের অপূর্ণতা থেকে তাঁকে মুক্ত রেখেছে। ‘সুবহান আল্লাহ’ শব্দটির অর্থও হলো আল্লাহকে সকল ত্রুটি ও অপূর্ণতা থেকে পবিত্র ঘোষণা করা। এ কারণেই অনেক বিষয়ই- যা অন্যদের জন্য প্রযোজ্য, তাঁর জন্য প্রয়োজন নয়। যেমন আমাদের জন্য কোন কাজ সহজ, কোন কাজ কঠিন, কোন কিছু আমাদের নিকটে রয়েছে, আবার অসংখ্য ও অগণিত বস্তু আমাদের থেকে দূরে অবস্থান করছে। অনেক ঘটনা আমাদের জন্য অতীত, অনেক ঘটনা বর্তমান বা ভবিষ্যৎ। অনেক বস্তু আমাদের থেকে ক্ষুদ্র, অনেক বস্তু আমাদের থেকে বড়। কারণ, যেহেতু আমরা সীমিত সত্তা তাই অন্য বস্তু ও ধারণার সাথে তুলনা করে আমরা নিজেদের অবস্থান যাচাই করে দেখি। কিন্তু এমন সত্তা যিনি অনন্ত ও অসীমতার জন্য নিকট-দূর, কঠিন-সহজ, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ ইত্যাদি অর্থহীন কারণ তাঁর জন্য সবই নিকটে, সবই সহজ এবং সবই বর্তমান। ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়’- আয়াতটি কখনই এ বিষয়টি বলার জন্য অবতীর্ণ হয়নি যে, কোন বস্তুর সঙ্গে আল্লাহর একশ ভাগ মিল নেই, কিন্তু এক ভাগ বা দশ ভাগ মিল রয়েছে। কারণ, পৃথিবীতে এমন কোন বস্তু নেই যা অপরটির সাথে একশ ভাগ সদৃশ ও অনুরূপ।

যেমন জড় পদার্থসমূহের আকৃতি ও গঠন পরস্পর থেকে ভিন্ন এমনকি সকল পাহাড় ও সকল সমুদ্র একরূপ নয়, জীবজগতও রূপ, বৈশিষ্ট্য ও আকার-আকৃতিতে পরস্পর অসদৃশ। এমনকি সকল মানুষ আকৃতি ও প্রকৃতিতে একরূপ নয় যদিও মানুষ হওয়ার দৃষ্টিতে তারা সকলে এক। তাই আয়াতটি তাঁর সঙ্গে অপর কোন বস্তুর বিন্দুমাত্র সদৃশতা প্রত্যাখ্যান করতেই অবতীর্ণ হয়েছে। কোন কিছুর সদৃশ না হওয়া এবং আল্লাহর অসীমতার ও দলিলসমূহ তাঁর বিশেষ স্থানে অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করে। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়ثمّ استوی علی العرش  আয়াতটি রূপক অর্থে এসেছে। কোন অবস্থাতেই একে বস্তুগত অর্থে গ্রহণ করা যায় না। মহান আল্লাহর দৈহিক সত্তা হওয়ার দাবি তাঁর অসীমতার পরিপন্থী এবং তা الله اکبر অর্থাৎ মহান আল্লাহর সকল কিছুর ঊর্ধ্বে ও শ্রেষ্ঠ হওয়ার ইসলামের চিরন্তন স্লোগানকে প্রত্যাখ্যান করে। তাছাড়াও এটি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্বতঃসিদ্ধ একটি বিষয় যে, কোন সীমিত সত্তাই অসীম ও অনন্ত জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। তেমনি অসীম কোন সত্তাকে সীমিত কোন আসন ধারণ করতে পারে না। 

অতএব, যারা আয়াতটিকে বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করে তারা প্রকৃতপক্ষে কোরআনের অন্যান্য স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আয়াত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলকে প্রত্যাখ্যান করে। আর তাই ثمّ استوی علی العرش আয়াতকে মহান আল্লাহর বিশ্বজগৎ পরিচালনা কর্মে নিয়োজিত হওয়া অর্থ করাই বাঞ্ছনীয়।

 

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: